করোনায় একাকিত্ব ও ভালোবাসা

করোনায় একাকিত্ব ও ভালোবাসা

আবদুল কাইয়ুম তুহিন- বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর:

১. একটি খুদে বার্তার অপেক্ষায়
একটা সময় চরম আগ্রহ থাকলেও এখন কেন যেন বেশ বিরক্তিই চলে এসেছিল, মুঠোফোনের খুদে বার্তায়। এর বড় কারণ, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রমোশনাল বিজ্ঞাপন, বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মসূচি, বিশেষ করে ভোট ও উৎসব ঘিরে চেনা–অচেনা হাজারো মানুষের শুভেচ্ছা বাণীতে বেশ বিরক্তই চলে এসেছিল খুদে বার্তায়।

কিন্তু করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর একটা খুদে বার্তার জন্য আমাকে যে কতটা প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে হয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। মুঠোফোনে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থেকেই কেটে গেল দুটি নির্ঘুম রাত। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ১০ জুন রাত পৌনে ১১টায় এল সেই কাঙ্ক্ষিত খুদে বার্তা। তা–ও আবার ‘নেগেটিভ’। আইইডিসিআরের এই খুদে বার্তাটি যেন আমার বুকের মধ্যে চেপে বসে থাকা হিমালয় পর্বতটাকে এক ধাক্কায় ছুড়ে ফেলে দিল।

হ্যাঁ, আমি করোনামুক্ত। মানুষ যেখানে নেগেটিভ থেকে পজিটিভ হওয়ার জন্য প্রাণপণে দৌড়ায়, সেখানে শুধু আমি কেন? পুরো পৃথিবী আজ পজিটিভ থেকে নেগেটিভ হতে ছুটছে। ২৪ মে প্রিয় প্রতিষ্ঠান চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন বিকেল পৌনে পাঁচটায় ঠিক এমনই এক খুদে বার্তা আমার জীবনকে পুরো এলোমেলো করে দিয়েছিল। দীর্ঘ তিনটি সপ্তাহ নিজের শরীরে অদৃশ্য শত্রুকে রেখে চালিয়ে যেতে হয়ে এক নতুন যুদ্ধ। যে যুদ্ধে জেতার কোনো বিকল্প ছিল না আমার হাতে। যে হেরেছে, তাকে হারতে হয়েছে, জীবন থেকেও। সৃষ্টিকর্তার কাছে হাজারো শুকরিয়া।

২. স্বপ্ন এসেছে বাড়ি
দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটায় আইইডিসিআরের একটা মিষ্টি খুদে বার্তা। ডানা থাকলে হয়তো রাতেই উড়াল দিতাম গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে। রাত পৌনে ১১টায় সে বার্তা আসায় এবার নির্ঘুম রাত কাটল সন্তানের মুখ দর্শনের অপেক্ষায়। বাড়ি আসতে সকালেই গাড়ি পাঠিয়ে দেন এক বড় ভাই। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে যখন সন্তানদের কাছে পৌঁছালাম, তখন বাধা কিছু বিধিনিষেধ! সঙ্গে মায়ের দুধে গোসলের অপেক্ষা। বড় কোনো বিপদ থেকে মুক্তি মিললে দুধ দিয়ে গোসল করানোর মিথ আছে আমাদের অঞ্চলে। শত নিষেধ করার পরও মায়ের ইচ্ছায় কাঁচা দুধে ভেজাতে হলো মাথা। বাড়িতে এসেই ছেলেমেয়েকে কাছে টেনে না নেওয়ায় ঘটে বিপত্তি। অভিমানের পাহাড় রূপ নিল পর্বতসমান। গোসল শেষে যখন কাছে ডাকলাম, তখন অভিমানের চূড়ান্ত রূপ দেখতে পেলাম। কথা বলা একেবারেই বন্ধ, অনেকটা শোকে পাথর হয়ে যাওয়ার মতো। তবে বাবার স্পর্শ পেতেই বরফ গলে ক্ষীর। আর বাড়িতে চলছিল স্বজনদের উল্লাস, এ যেন নতুন জীবন ফিরে পাওয়ার অনুভূতি। মা, স্ত্রী–সন্তান, ভাইবোনসহ স্বজনদের ভালোবাসায় সিক্ত হলাম স্বর্গের সুখে।

৩. করোনা ও আমি
জ্বর, গলাব্যথা, কাশি ও হালকা শ্বাসকষ্ট। এসব উপসর্গই প্রায় একসঙ্গে দেখা দেওয়ায় ২১ মে জাতীয় প্রেসক্লাবে করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিই। এরপর দ্রুত সময়ের মধ্যেই মোটামুটি বেশ ভালো হয়ে যাই। বন্ধ হয়নি অফিস করাও। ২৪ মে বিকেল পৌনে ৫টা, চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের সন্ধ্যা ৭টার নিউজ তৈরিতে ব্যস্ত। ইফতারের আগেই পুরো বুলেটিন সাজানোর কাজ সারতে হবে। হঠাৎ মুঠোফোনে খুদে বার্তা। কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াই আমি। নিউজ রুমে নিজেকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করি। খুদে বার্তার বিষয়ে আমাদের নির্বাহী পরিচালক তালাত মামুন ভাই ও আউটপুট এডিটর হাসান ইমাম রুবেল ভাইকে জানাই। তাঁরা বাসায় চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সর্বোচ্চ আশ্বাস দেন পাশে থাকার। যে পেশায় আছি, করোনায় যেকোনো সময় আক্রান্ত হতে পারি, এমন বাস্তবতায় শুরু থেকেই নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত রেখেছিলাম। এই প্রস্তুতিতে বড় ছেদ পড়ে দীর্ঘ সময় পরিবার পাশে না থাকায়। করোনাকালের শুরুতেই গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিই স্ত্রী-সন্তানদের। শুরুর দিকেই আমার ঠান্ডার প্রবণতাও ছিল বেশ। তাই একটু বেশি সতর্ক থাকতে হয়েছিল। করোনা পজিটিভের খবরে কিছুটা নিরাপদ দূরত্ব তৈরি করে সন্ধ্যা ৭টার নিউজ শেষে বাসায় ফিরি। লোকজন থাকায় ইনপুট এডিটর বিপ্লব শহীদ ভাইকেও তা জানানো সম্ভব হয়নি। আর কার সঙ্গে বিষয়টা শেয়ার করব, তা–ও বুঝতে উঠতে পারছিলাম না। ছোট ভাই রায়হান কাউছারকে জানাই। কারণ, সে আমার বাসায় থাকছে বেশ কয়েক দিন হলো। তবে আক্রান্তের সময়টাতে আমি একাই ছিলাম কয়েক দিন।

বাসায় ফিরেই বন্ধু ও কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের করোনা চিকিৎসক তৌহিদুর রহমান হামীমের সঙ্গে যোগাযোগ করি। অনলাইনে চিকিৎসাসেবা ও মনোবল চাঙা রাখার মন্ত্র দিয়ে দেয় সে। ওষুধ শুরু করে দিই ওই রাত থেকেই। আমি করোনায় আক্রান্ত, এ খবরটা এই চারজন ছাড়া আর কাউকেই জানাইনি। কারণ, ঈদের আগের রাতে আমার করোনায় আক্রান্তের খবরে মন খারাপ হতে পারে স্বজনদের। আর মাটি হয়ে যেত আমার পরিবারের ঈদ আনন্দ। তাই বাড়িতে তখনো মিথ্যা কথা বলতে হচ্ছিল। সবাই জানত, আমি অফিস নিয়েই ব্যস্ত আছি। নিজের মধ্যে অদৃশ্য শত্রুকে রেখে শুরু করি নতুন এক যুদ্ধ। স্বজনদের কাছে গোপন রেখে এই অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে একা লড়াই করা যে কতটা কঠিন ও ভয়াবহ, তা হয়তো বলে বা লিখে বোঝানো কঠিন। জানি, এ যুদ্ধে আমাকে লড়তে হবে একাই, আমাকে জিততেই হবে এবং থাকতে হবে বাসাতেই। হাসপাতালে যাওয়ার চিন্তা করা যাবে না দুঃস্বপ্নেও। পরিচিতজনের হাসপাতালের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা এই ভয়টা বাড়িয়ে দিয়েছিল বহুগুণে। ঈদের দুই দিন পর আমার পরিবার জেনে যায়, আমি করোনায় আক্রান্ত। ততক্ষণে আলহামদুলিল্লাহ আমি বেশ ভালো হয়ে উঠি শারীরিক ও মানসিকভাবে। আর করোনা আমার কাছে আনুষ্ঠানিক পরাজয় স্বীকারের অপেক্ষায় ছিল। ভিডিও কলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে আশ্বস্ত করতে হয়, আমি ভালো আছি। বাড়িতে, মসজিদে, দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা স্বজনেরা মহান রবের দরবারে দোয়া শুরু করলেন। আমার মেয়ে তামারা আফরিন ও ছেলে তারাজ আয়ান, স্ত্রী, মা, ভাইবোনদের সঙ্গে কথা বলেই কাটতে থাকল সময়। যদিও কয়েকজনের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার ও কথা বলা বন্ধ করতে হয়েছিল তাদের কান্নাকাটির কারণে। অনেকের ফোন পর্যন্ত ধরতে পারিনি। নামাজ পড়া, ছবি দেখা আর বাসায় নিজের শরীর ঠিক রাখার নানা কসরতে কাটতে থাকল সময়। এ সময়টাতে রায়হান ও কয়েকজন বন্ধু পাশে থাকায় একটি মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি আমি অসুস্থ। তবে এক রুমে বন্দী থাকাটা ছিল সবচেয়ে কষ্টের। আলহামদুলিল্লাহ দ্বিতীয় পরীক্ষায় ফল এল নেগেটিভ। তবে ফের ধাক্কাটা লাগে নতুন করে প্রচণ্ড ঠান্ডা লাগায়। চিকিৎসক বন্ধুর পরামর্শে আইইডিসিআর ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে দুটি টেস্ট দিই। ঠান্ডার প্রকোপ না কাটায় উদ্বেগটাও কমছিল না। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে একাকিত্বের আতঙ্কটাও। সময়ের সঙ্গে নিজেকেও বেশ অসহায় লাগতে শুরু করে। যা কারও সঙ্গে শেয়ারও করা যাচ্ছিল না। এ সময়টাতে বড্ড মিস করতে শুরু করলাম প্রিয় সন্তানদের স্পর্শ আর নিউজ রুমে হইহুল্লোড়। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটল ১০ জুনের রাত পৌনে ১১টায় দুটি মিষ্টি খুদে বার্তায়।

৪. একাকিত্ব
করোনা পরিস্থিতির শুরুর দিকেই স্ত্রী-সন্তানদের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে কালঘড়ায় আমার গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিই। সাংবাদিকতা পেশা, তার ওপর টেলিভিশনের একটি দায়িত্বশীল পদে থাকায় মহামারির এই সময়টাতে ছুটি কিংবা বাসায় থাকার কোনো সুযোগ ছিল না। তাই কখন কোন পরিস্থিতির শিকার হতে হয়, এই ভাবনা ও ভয় থেকে পরিবারের সদস্যদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া। আমার মানসিক বিড়ম্বনার শুরুটা এই একাকিত্বের মধ্য দিয়ে। এত দীর্ঘ সময় কখনো একা থাকা হয়নি এ জীবনে। ভীষণ রকমে মিস করতে থাকলাম বাচ্চাদের ‘বাবা’ ডাক। এরই মধ্যে চলে এল পবিত্র রমজান মাস। একাকিত্বের ভয়টা বাড়তে থাকল বেশ ভালো করেই। অফিসে যতক্ষণ থাকছি কাজের চাপে তা ভাবার হয়তো সময়ই হয় না, কিন্তু বাসায় ফিরলেই যত বিপত্তি। পরে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতা ও ছোট ভাই রায়হান কাউছারকে পাশে পাই। কিছুটা ঘুচল আমার একাকিত্ব। খাবারদাবারের সমস্যা তেমন একটা হয়নি শুরু থেকেই। স্বজনেরা পরম মমতায় সেই শুরু থেকেই খাবার সরবরাহ করে আসছিল। সঙ্গে অনলাইনে প্রিয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলেও বেশ ভালোভাবেই কেটে যাচ্ছিল সময়টা। তবে আমার জন্য সামনে কতটা ভয়াবহ বাজে সময় অপেক্ষা করছিল, তা চিন্তায়ও আসেনি। রায়হান কাউছার চলে গেল সাতক্ষীরায়, আর ওই রাতেই আমার জ্বর এল। তখন পুরো একা। অফিসেও যেতে পারলাম না। জ্বরের পর গলাব্যথা, মাথাব্যথা, কাশিও শুরু হলো। তৃতীয় দিন সকালে করোনা পরীক্ষা দিয়ে আসি জাতীয় প্রেসক্লাবে। ভয়ও বাড়তে থাকল সময়ের সঙ্গে। অদ্ভুত চিন্তা মাথায় এল, ভয় দূর করতে ভৌতিক ও ভয়াবহ ছবি দেখার! যেটা আমার ভয়ের চেয়েও বেশি ভয়াবহ। তখন ভয় ও ভূত মিলে একাকার হয়ে গেলাম। এ সময়টাতে নিজের মধ্যে কিছু কাল্পনিক চরিত্রও আবিষ্কারের চেষ্টা করলাম। কিছুটা হুমায়ূন আহমেদের হিমুর প্রভাব ফেলারও চেষ্টা ছিল। পরিবর্তন আনলাম জীবনাচারেও। চার–পাঁচ দিন পর ফিরল রায়হায়, ততক্ষণে আমি করোনায় আক্রান্ত একজন।

৫. পাশে পাওয়া অতিমানব
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী মুখ রায়হান কাউছারের সঙ্গে পরিচয়টা বেশি দিনের নয়। ভদ্র, মার্জিত ও নেতৃত্বের সব গুণেই যেন পরিপূর্ণ চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের এই ছেলেটি। করোনায় আক্রান্ত হয়েছি, শুরুতে যে তিনজন ব্যক্তিকে তা জানিয়েছি, তাদের মধ্যে রায়হান একজন। কারণ, আমার জ্বর আসার আগের দিনও এক টেবিলে বসে খেয়েছি। অসুস্থ হওয়ার আগের রাতে সে সাতক্ষীরা চলে যায়। আর করোনা রিপোর্ট পাওয়ার দিন ঢাকায় ফিরে আসে। অনেকটা ভয় নিয়েই করোনায় আক্রান্তের খবর জানাই। হাসিমুখে রায়হান জানায়, ‘আপনাকে ছেড়ে যাচ্ছি না আমি। এই সময়টাতে আপনাকে একা থাকতে দেওয়া যাবে না। যা হওয়ার হবে, চলেন বাসায় যাই। আপনি মানসিকভাবে শক্ত থাকেন। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, আমাকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই, আমি ঠিক আছি।’ যে সময়টাতে স্ত্রী-সন্তান, ভাই-বোনেরা ফেলে রেখে যাচ্ছে স্বজনদের, এমনকি মৃতদেহ পর্যন্ত নিতে আসছে না, সেই সমাজে মাত্র কয়েক দিনের পরিচিত রায়হান কাউছার ছেড়ে যেতে চাচ্ছে না আমাকে! যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে চললেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রায়হানকে নিয়েও বাড়তে থাকে উদ্বেগ। আমার স্বজনেরা যতটা না আমার খবর নিচ্ছেন, তার চেয়েও বেশি জানতে চাচ্ছেন, রায়হান ভালো আছে তো? সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনায় যোগ হয় ওর নামটাও। আমার দ্বিতীয় পরীক্ষার সময় রায়হানেরও করোনা পরীক্ষা করানো হলো। কাঙ্ক্ষিত ফল আসে ‘নেগেটিভ’। আমার বিশাল পরিবার। সময়ের ফেরে একা ছিলাম, বারবার কাছে ছুটে আসতে চেয়েছেন স্ত্রী-সন্তান, ভাইবোনেরা। রায়হান পাশে থাকায় বাড়তি সতর্কতার জন্য ওদের কাছে আসতে দিইনি। রায়হান কাউছার আমাকে আগলে রাখে পরম মমতায়, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়। মহামারির এই সময়টাতে সমাজে বড্ড বেশি প্রয়োজন রায়হানদের। ছাত্রলীগেরও ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হয়ে উঠুক এমন প্রতিটি রায়হান কাউছার।

৬. নীরব কান্না
বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারিতে মৃত্যুর মিছিলে প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে হাজারো নতুন নাম। বাংলাদেশের সংখ্যাটা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। একেকটি মৃত্যুর সংবাদে অস্থির করে তুলতে থাকে আমাকে। পরিচিত চেনাজানা বেশ কয়েকজন চলে যাওয়ার খবরে আহত হতে লাগলাম। মৃতদেহ নিতে আসছে না স্বজনেরা, কিংবা দাফন করতে দিচ্ছে না এলাকার মানুষ, এমন কয়েকটি খবরে ভীষণ রকম অস্থির করে তুলে আমাকে। আমার সঙ্গেও কি এমন কিছু ঘটার অপেক্ষায়, এমন শঙ্কায়। আমার অবুঝ সন্তান তারাজ আয়ান, যার পৃথিবীজুড়ে শুধুই বাবা...সে কি একটিবারের জন্য আমায় আর আদর করতে পারবে না! আমার পৃথিবী তামারা আফরিন, একবারও কি ছুঁয়ে দেখবে না তার বাবাকে। নাকি পরম ভালোবাসা পাওয়া সন্তান ও স্বজনদের স্পর্শ ছাড়াই বিদায় নিতে হবে আমাকে! আমার মমতাময়ী মায়ের ছোঁয়াটাও কি আমি পাব না, কিংবা বাবার কবরের পাশে আমার জায়গা হবে না! দেহটাও থাকবে কিছু অপরিচিত অচেনা দেহের সঙ্গে অনাদরে-অবহেলায় মায়াহীন এই শহরের কোনো এক গোরস্তানে! নিজেকে যতই শক্ত ও সাহসী রাখার চেষ্টা করছি, ততই এসব চিন্তা ও প্রশ্ন আমাকে অসহায় করে তুলতে থাকল। সিজদায় পড়ে গিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে কেঁদে বলেছি, আল্লাহ এমন মৃত্যু আমায় দিয়ো না, যে মৃত্যুতে শেষ বিদায়ে প্রিয়জনকে পাশে পাব না। শুরুর দিকে কিছু মুভি দেখে সময় কাটালেও সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সে আগ্রহটাও কমে আসে। মুঠোফোনে থাকা সন্তান ও স্বজনদের ছবি দেখতে দেখতে কখন যে দিন শেষ হয়ে যেত, তা বুঝতেই পারতাম না। কখনো কখনো দেখতাম মাথার নিচের বালিশটা ভিজে আছে মনের অজান্তেই। যে কান্নার সাক্ষী শুধুই আমার দুচোখ।

৭. ভালোবাসার বাটি
করোনা পরিস্থিতিতে ঢাকায় একা থাকায় আমার পরিবার ছিল বেশ উদ্বিগ্ন। তবে এই শহরে বন্ধুরা ছিল আমার ভরসার জায়গা। হারানো বন্ধুদেরও ফিরে পেয়েছি করোনাকালে। চরম ভিতু বন্ধুটিও কীভাবে সাহসী হয়ে ওঠে, তা–ও দেখেছি এই মহামারির সময়টাতে। সবার নাম নেওয়াটা হয়তো কষ্টকর, তবে দুই–চারজনের নাম না নিলেই নয়। ব্যাংকার বন্ধু সাইদুল ইসলাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আফরোজা মনি, ব্যাংকার ছোট ভাই আবুল কালাম আজাদ ও রাজিয়া সুলতানা লতা ভাবি, সাংবাদিক ছোট ভাই সিকান্দার রেমান। প্রতিদিন খাবার নিয়ে শহরের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছেন ভয়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে। সাঈদ ও আজাদকে কত যে বকেছি প্রতিদিন বাসার সামনে আসার কারণে, তারও কোনো ইয়ত্তা নেই। এ এক অদ্ভুত ভালোবাসায় সিক্ত হতে লাগলাম আমি। তাদের জন্য হয়তো কৃতজ্ঞতা প্রকাশই যথেষ্ট নয়। তাদের ভালোবাসার খাবারের বাটি জমতে জমতে ছোটখাটো পাহাড় হয়ে গেছে আমার বাসার ডাইনিং রুম। এ সময়টাতে কিছু মিরাকল ঘটনাও ঘটেছে খাবার নিয়ে। মন চেয়েছে জর্দা, কাচ্চি, গরুর কালা ভুনা বা শর্ষে ইলিশ খেতে। অনেকটা জাদুর কাঠির মতো দু–এক দিনের মধ্যে তা হাজির। অথচ আমি তা কারও সঙ্গে শেয়ার করিনি কিংবা খাওয়ার আগ্রহও প্রকাশ করিনি। এই সময়টাতে যাঁরা পাশে থাকতে পারেননি, সেই সব স্বজন সারাক্ষণই তাঁদের হৃদয়ে রেখেছেন প্রার্থনায়। দূরে থাকা বন্ধু-স্বজনদের উদ্বেগ আমার করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করার সাহসটা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। তাই তো শত কষ্ট, ভয়ে কান্না লুকিয়ে হাসি মুখে সবাইকে বলতে পেরেছি, আমি ভালো আছি। ভালো থাকুক বাংলাদেশ।