কুড়িগ্রামে সড়কে নিম্নমানের ইরানি বিটুমিন

কুড়িগ্রামে সড়কে নিম্নমানের ইরানি বিটুমিন

***হাতেনাতে ধরা ঠিকাদার

***বাধা দিয়ে বদলির হুমকিতে রেল প্রকৌশলী

মো. ইব্রাহীম হোসেন: মানহীন নিষিদ্ধ ইরানি বিটুমিনে তৈরি হচ্ছিল কুড়িগ্রাম নতুন রেলওয়ে স্টেশনের সংযোগ সড়কটি। এতে জোর আপত্তি তোলেন তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত রেলওয়ের একজন প্রকৌশলী। এ কারণে তাকে বদলির হুমকি দিয়েছেন অভিযুক্ত ঠিকাদার।

ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী বলছে, তাদের দীর্ঘদিনের দাবির মুখে সড়কের উন্নয়নকাজ শুরু হয়। নিম্নমানের বিটুমিন দিয়ে সড়কের মান খারাপ করা তারা মেনে নেবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমদানিকারকদের একটি সিন্ডিকেট রাখঢাক ছাড়াই কৌশলে দেশে ইরানি বিটুমিনের চালান ঢোকাচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের উৎপাদিত দাবি করা হলেও অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব বিটুমিনের উৎস আমদানি নিষেধাজ্ঞায় থাকা দেশ ইরান।

ইরানে ৮০ থেকে ১০০ গ্রেডের বিটুমিন কিনে সংযুক্ত আরব আমিরাতে এনে ভেজাল মেশানো হয়। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে যখন পৌঁছায় সেই বিটুমিন তখন আলকাতরা! পরীক্ষা ছাড়া তা খালাসও হয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরে। সড়ক বিশেষজ্ঞরা এসব বিটুমিনের ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তুলে আসছেন।

খোদ সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাও এই মানের বিটুমিন ব্যবহার না করতে জোর দিয়ে নির্দেশনা জারি করেছে। কিন্তু কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে ভেজাল বিটুমিনের ব্যবহার চলছেই। সর্বশেষ কুড়িগ্রামে হাতেনাতে এই বিটুমিনের ব্যবহার ধরা পড়ল। কুড়িগ্রাম কাণ্ড : কুড়িগ্রামের জরাজীর্ণ রেলওয়ে স্টেশনের ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা থেকে ১ কোটি টাকা ব্যয়ে ১ হাজার ৩০০ ফুট দৈর্ঘ্যরে সুন্দর ও আধুনিক প্ল্যাটফর্ম নির্মাণ করা হয়।

একই সঙ্গে দীর্ঘ চার দশক অপেক্ষা শেষে আর কে রোড থেকে স্টেশনে প্রবেশের সংযোগ সড়কটিও মেরামতের উদ্যোগ নেয় রেলওয়ে। রেল কর্তৃপক্ষ ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ফুটপাত, ড্রেন, ডিভাইডার ও সংযোগ সড়কের কাজও শুরু করে এলাকাবাসীর দাবিতে সাড়া দিয়ে। সড়কের দুই পাশে ড্রেন, কংক্রিট ব্লকের ফুটপাত, ডিভাইডার এবং কার্পেটিংসহ সব কাজ প্রায় শেষের দিকে। শুধু গ্রিল ও সিলকোটের ফিনিশিং বাকি।

সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, সিলকোটের কাজ করার জন্য গত ৭ মে ঠিকাদার উদ্যোগ নিলে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী দেখতে পান যে নিম্নমানের ৮০ থেকে ১০০ গ্রেডের ইরানি বিটুমিন আনা হয়েছে। প্রকৌশলী নিম্নমানের বিটুমিন দিয়ে কাজ করা যাবে না বলে ঠিকাদারকে সাফ জানিয়ে দেন। এতে ঠিকাদার চড়াও হয়ে প্রকৌশলীর সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন, তা দেখে স্থানীয় লোকজনও এর প্রতিবাদ করে।

এ সময় ঠিকাদারের লোকজন প্রকৌশলীকে বদলি করাসহ নানা ধরনের হুমকি দেয়। এলাকাবাসীর বাধার মুখে কাজ বন্ধ করে দেন প্রকৌশলী। রেলওয়ের জ্যেষ্ঠ উপসহকারী প্রকৌশলী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘কোনোভাবে যদি মার্কেটে ৬০ থেকে ৭০ গ্রেডের বিটুমিন না পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে কাজ চলমান রাখার স্বার্থে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিকল্প পথ রাখে।

কিন্তু এ মুহূর্তে বাজারে উন্নতমানের ৬০ থেকে ৭০ গ্রেডের বিটুমিনের সরবরাহ ভালো। এর পরও ঠিকাদার জোর করে নিম্নমানের ইরানি বিটুমিন দিয়ে কাজ করাতে চাচ্ছিলেন। তাই কাজ বন্ধ করে দিয়েছি।’ জানা গেছে, এ কাজে দিনাজপুরের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আল আমিন ট্রেডার্সের নামে হলেও মূল ঠিকাদার গাইবান্ধার মহিমাগঞ্জের জহুরুল হক।

এ ব্যাপারে জহুরুল হকের বক্তব্য হচ্ছে, ‘শিডিউলে ৬০ থেকে ৭০ গ্রেড অথবা ৮০ থেকে ১০০ গ্রেডের কথা উল্লেখ আছে। সে জন্য আমরা ৮০ থেকে ১০০ গ্রেডের ইরানি বিটুমিন নিয়ে এসেছি। বাজারে ৬০ থেকে ৭০ গ্রেডের বিটুমিন পাওয়া যায় না।’ তবে স্থানীয় লোকজন জানায়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান উন্নতমানের বিটুমিন না পাওয়ার যে দাবি তুলেছে, তা সঠিক নয়। বাজারে এখন উন্নতমানের বিটুমিনের সরবরাহ ভালো।

এমনকি দেশীয় একটি কোম্পানি উন্নতমানের বিটুমিন তৈরি করছে। ফলে এখন আর ইরানের ভেজাল বিটুমিনের ওপর নির্ভর করা লাগে না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিজেদের আখের গোছাতে সরকারের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভেজাল বিটুমিন ব্যবহার করতে চেয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম ও রেজাউল আলম বলেন, সড়কে ভেজাল বিটুমিন দিয়ে কাজ করে কোটি কোটি টাকা ক্ষতি করেছে। ভেজাল বিটুমিনে কাজ করলে সড়ক টেকসই হয় না। অল্প দিনেই সড়ক ভেঙে যায়। তাই দেশে উৎপাদিত উন্নতমানের বিটুমিন দিয়ে যেন সড়কের কাজ করা হয়।

এদিকে প্রকৌশলীকে বদলির আলটিমেটাম দিয়ে কাজ বন্ধ রেখেছে ঠিকাদারচক্র। তারা বলেছে, যতক্ষণ না প্রকৌশলীকে বদলি করা হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কাজ বন্ধ থাকবে। তবে এমন দাবিকে জিম্মি করা বা অন্যায় হিসেবে দেখছেন এলাকাবাসী ও রেলওয়ে কর্মকর্তারা। এলাকাবাসী বলছে, এমন সৎ প্রকৌশলী প্রতিটি জেলায় দরকার।

নিম্নমানের বিটুমিন ধরে তিনি সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। স্থানীয় কলেজ শিক্ষক আব্দুল কাদের জানান, কুড়িগ্রাম জেলাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির ফসল ছিল এই উন্নয়নকাজ। নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহারের জেরে কাজটি হুমকিতে পড়ে গেল। মূলত যাত্রীদের নিরাপদে ট্রেনে ওঠানামার জন্য এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। আর কে রোড থেকে স্টেশনে ঢোকার সংযোগ সড়কটি দীর্ঘ চার দশকেও মেরামত না করায় সেটি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।

প্রকল্পের নির্ধারিত মেয়াদে কাজ শেষ না হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে অসমাপ্ত রাস্তাটির ক্ষতি হতে পারে বলে মনে করছে এলাকাবাসী। স্টেশন এলাকার বাসিন্দা নূর বক্ত মিয়া, আলতাফ হোসেন ও নূর আলম জানান, বর্তমান রেলের প্রকৌশলী সাইনবোর্ড টাঙিয়ে শিডিউল অনুযায়ী ভালোমানের কাজ করাচ্ছেন। ঠিকাদাররা সুবিধা আদায় করতে পারছেন না দেখে প্রকৌশলীকে বদলির চেষ্টা করছেন।

লালমনিরহাট রেলওয়ের বিভাগীয় প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘শিডিউল অনুযায়ী কাজ চলবে। ঠিকাদারের ১৮০ দিন অতিবাহিত হয়েছে এটা ঠিক। তবে ওনারা সময় বাড়ানোর আবেদন করেছেন এবং সেটি ডিজি মহোদয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এ ছাড়া ঠিকাদারকে অবশিষ্ট কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে।’

বিআলো/ইলিয়াস