নিঃসীমানার বেড়া’ ডিঙিয়ে তুষার কান্তি সরকার

নিঃসীমানার বেড়া’ ডিঙিয়ে তুষার কান্তি সরকার

নিজস্ব প্রতিবেদক : ‘নিঃসীমানার বেড়া’ একটি ভ্রমণবিষয়ক সাহিত্যের মোড়কবন্দী। লেখকের কথায়- ‘নিঃসীমানার বেড়া। ‘নিঃসীমানার’ কথাটার মধ্যেই একটা মানা আছে, একটা সীমাও। আবার সব বেড়ার মধ্যেই আছে গণ্ডি ছাড়িয়ে যাবার আপাত ঔদ্ধত্য ‘আশকারা’’। কথাসাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ বইটির মুখবন্ধে লিখেছেন, ‘কৌশিক লাহেড়ী বিদেশ ও স্বদেশের বহু জায়গায় ভ্রমণ করেছেন। তাকে এককথাতে বললে ‘বিশ্বভ্রমী’ বলতে হয়। তিনি যত বিদেশে ভ্রমণ করেছেন এবং দেশেরও যত জায়গাতে গেছেন তার এক একটি নিয়েই আলাদা আলাদা বই লিখতে পারতেন এবং লেখা হয়তো উচিৎও ছিল’। লেখক অমিতাভ সেনগুপ্ত লিখেছেন, ‘ভ্রমণের অন্দরমহলটা খুব ভালো চেনেন কৌশিক। তিনি যাদের ফ্রেমে টানেন সেই কুশীলবেরা এক একটি স্বয়ংসিদ্ধ গল্প হয়ে যায় নিজেরই হয়তো বা গল্পকারের অজান্তে। গ্রিসের দীর্ঘদেহী সুপুরুষ ট্যাক্সিচালক, পারি শহরের পলিতকেশ হেটেল রিসেপশনিস্ট, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের নাশকতায় নিঃস্ব অথচ অপরাজিতা মেয়েটি কৌশিকের দেশ-অন্তর্দেশ দর্শনবৃত্তকে পূর্ণ করে, লেখকের সূ² রসবোধ, সুখপাঠ্য গদ্যে অবারিত নিঃসীমানার বেড়া’।

কৌশিক লাহিড়ী একজন সুলেখক, যশস্বী চিকিৎসক। পরিযায়ী হয়ে দুচোখের দেখাকে এঁকেছেন বইয়ের পাতায়। পাঠক পড়তে পড়তে লেখকের হাত ধরে ওই ছবি স্পষ্ট দেখতে পান। লেখকের শুধু ভ্রমণ করার জায়গাগুলোর ছবিই আঁকেননি একইসঙ্গে তুলে ধরেছেন ওই স্থানের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তাঁর বাংলা শব্দভাণ্ডার যথেষ্ট সমৃদ্ধ। লেখায় কবিতা দোল খায়। গদ্যেরও যে ছন্দ আছে ডাক্তার লাহেড়ীর লেখা পড়লে সেটা বোঝা যায়।

‘সুন্দরীকাটির বনী’ পর্বে লেখক লিখেছেন, ‘সন্ধে সাতটার একটু পরে পুব দিগন্তে বাঘের হলুদ মাথার মতো উঁকি মারল অতিকায় শ্রাবণী পূর্ণিমার চাঁদ। তারপর মেঘের ডালপালা ছড়িয়ে রওনা দিল মাঝ আকাশে। বর্ষার টইটম্বুর নদীর জল, এক আকাশ অলৌকিক জ্যোৎস্না, আর ওপাশে ঘন ম্যানগ্রোভ অরণ্য। এই না হলে সুন্দরবন’! লেখায় সাবলীলতা, কাব্যিকতা আর সাহিত্যরস মুগ্ধ করবে পাঠকে।

বইয়ের প্রত্যেকটা পর্বের শিরোনামগুলোতেও মুন্সীয়ানার ছাপ পরিলক্ষিত ‘পরবাস, প্রিয়ভাষ’, ‘মার্কিন মুলুকের ময়নাদ্বীপে’, ‘মূর্ত-মুক্তির গল্পো’, ‘জিম করবেটের জিম্মেদারি’, ‘ওই রে তরী দিল খুলে’, ‘তেহরানে তেরাত্তির’, ‘বেজিং-এ বসন্ত’, ‘দিগন্তে নীল’, ‘আরশিনগরের দিনলিপি’, ‘মহাবলেশ্বর পঞ্চগনি’, ‘ব্যাংকক বর্ণনা’, ‘নেপালের চিতবনে’, ‘কাকানিতে কেউ যায় না’, ‘বনভূমি, মনোভূমি’, ‘ম্যাকলাস্কিগঞ্জ বেতলা মারুমার’, ‘সুন্দরীকাটির বনী’, ‘ভাস্কো দা গামার দেশে’, ‘নিঃসীমানার বেড়া’, ‘জোহানেসবার্গের জলছবি’, ‘ভূস্বর্গের দিনলিপি’, ‘বর্ণময় বোর্নিও’, ‘কলম্বাসের নিজের দেশে’, ‘ফুমদি, সাঙ্গাই, লোকতাকের দেশে’, ‘বাইরে, দূরে’, ‘বড়াপানি’, ‘সামচি মালবাজার ঝালং’, ‘রূপমতীর দেশে’, ‘পুনরাগমনায় চ’ ও ‘মেন্দাবাড়ির গল্পো’।

প্রত্যেকটা পর্বের প্রয়োজনীয় ছবি সংযোজিত হয়েছে যা তুলেছেন লেখক নিজেই। পড়ার ঘোরে পাঠক এক সময় নিজেকে আবিষ্কার করবেন উক্ত স্থানে। অচেনাকে চেনা, অজানাকে জানা মানুষের চিরন্তন কৌতূহল। বইটি সেই কৌতূহল মেটাবে পাঠকের। ‘নিঃসীমানার বেড়া’ ভ্রমণবিষয়ক বইয়ের লেখক কৌশিক লাহিড়ী এ দিক দিয়ে পুরোপুরি সফল। পাঠককে তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো লেখার জাদুতে আটকে রেখেছেন। পাঠক পড়তে পড়তে আস্বাদন করেছেন ‘নিঃসীমানার বেড়া’র অমৃতরস।

‘নিঃসীমানার বেড়া’ বাংলা ভ্রমণসাহিত্যে নিঃসন্দেহে এক অনন্য সংযোজন। বইটিতে ব্যবহৃত সাদাকালো ছবির পরিবর্তে রঙিন ছবি ব্যবহার হলে দাম বাড়লেও আরো আকর্ষণীয় হতে পারতো। মেকাপ ও নির্ভুল বানানের জন্য সতর্ক দৃষ্টি দেয়ার প্রয়োজন ছিল। সাদামাঠা প্রচ্ছদটা আরো দৃষ্টিনন্দন করা যেত।

‘নিঃসীমানার বেড়া’ বইটি কলকাতা থেকে ১ শ্রাবণ, ১৪২১ প্রকাশ করেছে ট্র্যাভার্স প্রোডাকশনস অ্যান্ড পাবলিকেশনস। ১৮৬ পৃষ্ঠার বইটির বিনিময় মূল্য ২৫০ টাকা।