পানিবন্দি মানুষের ভোগান্তি, প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা

পানিবন্দি মানুষের ভোগান্তি, প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা

নিউজ ডেস্ক: যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিন প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে শত শত পরিবার। এসব এলাকায় বিশুদ্ধ পানি সংকট ও স্যানিটেশনসহ নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। মানুষজন বাঁধ ও উঁচু স্থানে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। 

সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকার রাণীগ্রামের পাশাপাশি বাঁধ অভ্যন্তরে বসবাসকারী খোকসাবাড়ি নতুনপাড়া, কারিগরপাড়া, গুণেরগাতি, পুঠিয়াবাড়ি ও চর মালসাপাড়া, সদর উপজেলার কালিয়া হরিপুর ইউনিয়নের বিয়ারা ও সয়দাবাদ এলাকা কয়েক শত পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এসব মানুষ বাঁধ ও আশপাশের উঁচু স্থানে আশ্রয় নিতে শুরু করেছেন।

গত ২৪ ঘণ্টায় ধনু, ঘোড়াউত্রা ও কালনী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলের অষ্টগ্রাম, ইটনা, মিঠামইন উপজেলার ১৩০টি গ্রামের প্রায় দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। রাস্তাঘাট, বসতবাড়ি, বাজার ও বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি উঠে গেছে। ইতোমধ্যে ইটনা ও মিঠামইন উপজেলার প্রায় সাড়ে ৭ হাজার পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। 

ইটনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাফিসা আক্তার জানান, উপজেলায় ৪৯টি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। বন্যাকবলিতরা সেখানে আশ্রয় নিচ্ছেন।
মিঠামইন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, এই উপজেলার প্রায় সাতশ পরিবারের বাড়িতে পানি উঠেছে। ইতোমধ্যে প্রায় ছয়শ পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছে।

অষ্টগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. হারুন-অর-রশিদ জানান, অষ্টগ্রামে ৩১টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত আছে। বন্যাকবলিতরা এসে আশ্রয় নিচ্ছেন। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম গত শনিবার ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও করিমগঞ্জের বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। এ সময় শুকনো খাবার বিতরণ করেন। সরকারিভাবে ইতোমধ্যে ১৪০ মেট্রিকটন চাল এবং আড়াই লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। 

এ সময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মতিউর রহমান, বিভিন্ন উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মতিউর রহমান জানিয়েছেন, হাওরের অলওয়েদার রোড ইটনার দিকে কিছুটা নিচু। ফলে আর আড়াই ফুট বা তিনফুট পানি হলেই রাস্তাটি ডুবে যাবে। সিলেট অঞ্চলে যেভাবে পানি বাড়ছে, এই পানি কিশোরগঞ্জের হাওরেও ঢুকবে। ফলে সামনে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।

সিলেটে স্থির বন্যার পানি, কমছে না দুর্ভোগ সিলেটে বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকায় পানি স্থির থাকলেও নিম্নাঞ্চলে এখনো গলা সমান বন্যার পানি রয়েছে। সোমবার সকালে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সিলেট নগরের বিভিন্ন এলাকায় পানি স্থির রয়েছে। শুধুমাত্র কিছু উঁচু এলাকা থেকে পানি নেমেছে। তবে নিম্নাঞ্চল এখনো আগের মতোই প্লাবিত।

সেখানে কোমর থেকে গলা সমান পানি। বিশেষ করে, নগরের অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত উপশহরের অবস্থা খুবই খারাপ। এ এলাকার অধিকাংশ স্থানে বুক থেকে গলাসমান পানি। এ ছাড়া জেলার কোম্পানিগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, দক্ষিণ সুরমা, সিলেট সদর, বিশ্বনাথসহ বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকায় এখনো বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে।

এদিকে সিলেট ও সুনামগঞ্জের কিছু এলাকায় পানি কমতে শুরু করলেও অন্য জেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। দুর্গত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যাও কম। মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে উঠলেও খাবার ও পানির তীব্র সংকট। সরকারি- বেসরকারিভাবে ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। আশ্রয়কেন্দ্রে শিশু ও বয়স্করা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানান, নতুন করে রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, জামালপুর, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে বন্যা দেখা দিয়েছে। এখন ১২টি জেলার ৭০টি উপজেলায় বন্যা রয়েছে। এটা বাড়ছে।

তিনি জানান, সিলেট-সুনামগঞ্জে এ পর্যন্ত এক কোটি মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া হয়েছে। দুই জেলায় দুই কোটি ৬০ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বন্যাকবলিতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড এবং ফায়ার সার্ভিস উদ্ধারকাজ করছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক এ কে এম সাইফুল ইসলাম গতকাল রবিবার বলেন, সিলেটে আজকের পর থেকে বন্যার পানি ধীরে ধীরে কমতে পারে। তবে বর্তমানে বিপৎসীমা অতিক্রম করে রেকর্ড লেভেলে রয়েছে। এ জন্য পানি সম্পূর্ণ নামতে এক সপ্তাহ লাগতে পারে। বন্যার পানি বৃদ্ধির ধারা হ্রাস পেতে পারে। সারাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে একটু সময় লাগবে।

সাইফুল ইসলাম আরো বলেন, সুনামগঞ্জের বন্যার পানি আগামী ৪৮ ঘণ্টায় নেমে যাবে। এক সপ্তাহ ধরে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। গত শনিবার ১২০ মিলিমিটার ও গত রোববার ২৩৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই বৃষ্টির পানি সিলেট-সুনামগঞ্জসহ সংশ্লিষ্ট অঞ্চল থেকে এখনো নামছে। 

সুরমায় পানি কমছে, বাড়ছে কুশিয়ারায় : সিলেটে সুরমা নদীর পানি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করলেও বাড়ছে কুশিয়ারা নদীর পানি। তবে সুরমা নদীর পানি সামান্য কমলেও জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। ইতোপূর্বে প্লাবিত এলাকার বেশিরভাগ এখনও পানির নিচে। নগরীর নিন্মাঞ্চলের বাসাবাড়ি ও রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে রয়েছে। উপশহরের প্রধান সড়কে এখনও কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও কোমর পর্যন্ত ডুবে যায়। ফলে বন্যা কবলিত এলাকায় মানুষের দুর্ভোগ দীর্ঘায়িত হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী, সোমবার সকাল ৯টা পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে ১৮ সেন্টিমিটার ও সিলেট (নগরী) পয়েন্টে ১ সেন্টিমিটার কমেছে। একই সময়ে কুশিয়ারা নদীর পানি শেরপুর পয়েন্টে কমলেও ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ৫ সেন্টিমিটার বেড়েছে। অবশ্য সারি ও লোভাছড়া নদীর পানি কমেছে।

সোমবার সকাল ১১টার দিকে সুরমা নদীর সিলেট পয়েন্টে বিপদসীমার দশমিক ৫৫ সেন্টিমিটার ও কানাইঘাটে ১ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। অন্যদিকে কুশিয়ারা নদীর অমলসিদ পয়েন্টে ১ দশমিক ৮৪ সেন্টিমিটার, শেওলা পয়েন্টে বিপদসীমার দশমিক ৬৩ সেন্টিমিটার ও ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার দশমিক ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

সিলেটে পাউবোর উপ-সহকারী প্রকৌশলী একেএম নিলয় পাশা জানান, ‘আজ সুরমা নদীর পানি আরও কমবে।’ তিনি বলেন, ‘কুশিয়ারা নদীর পানি বাড়ার কারণে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার কিছু এলাকা নতুন করে প্লাবিত হতে পারে। তবে তা মারাত্মক কিছু হবে না।’ এ ছাড়া গোয়াইনঘাট, কোম্পানিগঞ্জ, জৈন্তাপুর, সদর, কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, বিশ্বনাথ, ওসমানীনগর, বালাগঞ্জে প্লাবিত এলাকার পানি ধীরে ধীরে কমছে বলে জানান তিনি।

এদিকে নদীর পানি কমতে থাকায় নগরীতে প্লাবিত এলাকাগুলোর পানিও কমতে শুরু করেছে। তবে উপশহর, তালতলা, তেররতন, ঘাসিটুলাসহ বিভিন্ন এলাকা এখনও পানি রয়েছে। নগরীর বেশিরভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু হলেও প্লাবিত এলাকার মানুষ এখনও অন্ধকারে রয়েছেন। এসব এলাকায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় চরম সংকটে রয়েছেন নগরবাসী।

বিআলো/শিলি