বেপরোয়া ইউএস বাংলা

বেপরোয়া ইউএস বাংলা

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ কালোবাজারি, সোনা চোরাচালান ও ভ্যাট ফাঁকিতে বেপরোয়া ইউএস বাংলা গ্রুপ। মাত্র ১ দশক আগে প্রতিষ্ঠিত ইউএস বাংলার এখন ১২টির বেশি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ রাজস¦ আত্মসাৎ করে মাত্র কয়েক বছরে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গেল কয়েক বছরে রেকর্ড পরিমাণ সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত হয়েছে ইউএস বাংলা গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ও  দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বেসরকারি এয়ারলাইন্স ইউএস বাংলা। সোনা চোরাচালানে অন্য অনেক এয়ারলাইনসের নাম এলেও কয়েক বছর ধরেই ঘুরে ফিরে আসছে ইউএস-বাংলার নাম। 


শুধু যাত্রী নয়, স্বর্ণের বারসহ ধরা পড়ছেন এই এয়ারলাইনসে কর্মরত এয়ার হোস্টেজ, কাস্টমার সার্ভিস অফিসার, এমনকি ক্যাটারিং সার্ভিসের কর্মীরা। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিচ্ছেন। তবে আশ্চর্যজনক হলেও আড়ালেই থেকে যাচ্ছে চোরাচালানে জড়িত গডফাদাররা। এ নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন অনেক অপরাধ বিশেষজ্ঞ। তারা বলছেন, কর্তৃপক্ষের উচিত হবে এসব মামলার তদন্তে গভীরে গিয়ে মূল গডফাদারদের শনাক্ত করা।এরপর আইনের আওতায় নিয়ে আসা। না হলে, এভিয়েশন সেক্টরেকে এর জন্য মূল্য দিতে হবে। 


কাস্টমস সূত্র মতে গত বছরের ১২ জানুয়ারি শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে ৪ কেজি ৬৪০ গ্রাম সোনা উদ্ধার করে ঢাকা কাস্টম হাউজ। যার আনুমানিক বাজারমূল্য ২ কোটি ৩২ লাখ টাকা। চোরাচালান প্রতিরোধের অংশ হিসেবে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ফ্লাইট নম্বর বিএস ৩১৬-এর যাত্রী নামার সিঁড়ির নিচে ওই চালানটির ৪০টি সোনার বার পাওয়া যায়। একই বছরের ৩১ জুলাই একই বিমানবন্দরে ইউএস বাংলার যাত্রী বহনকারী গাড়ির চালকের কাছ থেকে ৩ কেজি ৭১২ গ্রাম সোনা উদ্ধার করে কাস্টমস কর্মকর্তারা। যার আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা। এরও আগে ২০১৯ সালের ২২ নভেম্বর শাহজালালে তিনটি সোনার বারসহ ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের কাস্টমার সার্ভিস অ্যাসিস্ট্যান্ট ওমর ফারুককে আটক করে ঢাকা কাস্টম হাউজ।


বিদেশ থেকে সোনার বারগুলো নিয়ে আসা মামুন মিয়া নামে এক যাত্রীকেও আটক করা হয়। ওই সোনার আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ১৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা। একই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে সোনা চোরাচালানে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ১০ কেজি সোনার বারসহ গ্রেপ্তার ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের কেবিন ক্রু রোকেয়া শেখ মৌসুমী। এর আগে ৫ সেপ্টেম্বর সকালে এপিবিএন সদস্যরা মৌসুমীকে প্রায় ১০ কেজি সোনাসহ গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনায় এপিবিএনের এসআই হেলাল উদ্দিন বাদী হয়ে মৌসুমীসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় সোনা চোরাচালান আইনে মামলা করেন।

মামলায় ইউএস-বাংলা থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে যোগ দেওয়া কেবিন ক্রু নেছার উদ্দিন, তার স্ত্রী, যাত্রী সুহেল খাঁ, লাকী ও বাপ্পীকে আসামি করা হয়। একই বছরের ২০ এপ্রিল ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট থেকে প্রায় ৭ কোটি টাকা মূল্যের ১৪ কেজি সোনা জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দারা। ওইদিন বিকালে ব্যাংকক থেকে শাহজালাল বিমানবন্দরে আসা ফ্লাইটটির টয়লেটে ওই সোনা পাওয়ার কথা জানায় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। তারও আগে ২০১৭ সালের ১১ অক্টোবর শাহজালাল বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট থেকে ৪ কেজি ৬৪ গ্রাম সমান সোনার বার উদ্ধার করে ঢাকা কাস্টম হাউজ। বিমানটির (ফ্লাইট নম্বর বিএস৩২২) ১১এ ও ১১বি সিটের ভেতর থেকে ওই সোনা উদ্ধার করা হয়। যার আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ২ কোটি ৩২ লাখ টাকা। একই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর শাহজালাল বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট থেকে ৪ কেজি ৬৬৫ গ্রাম সমান সোনার বার উদ্ধার করে শুল্ক গোয়েন্দা। যার আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। 


ইউএস বাংলা গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠানের একটির বিরুদ্ধে সোনা চোরাচালান ও আরেকটির বিরুদ্ধে বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধার অপব্যবহার এবং অর্থ পাচারের তথ্য রয়েছে ভ্যাট বিভাগের কাছে। এ অবস্থায় ইউএস বাংলা গ্রুপের ১২ অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে ফাঁকি খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে ভ্যাট বিভাগ সূত্র। 
এ প্রসঙ্গে জাতাীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর সদস্য (ভ্যাট বাস্তবায়ন ও আইটি) ড. আবদুল মান্নান শিকদার বলেন, অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন চলমান প্রক্রিয়া। এ জন্য অডিট করা হয়। মাঠ পর্যায়ে ভ্যাট গোয়েন্দাও কাজ করছে। জানা গেছে, মাত্র এক দশক আগে ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউএস বাংলা গ্রুপের এখন ১২টির বেশি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।

এগুলো হলো- ইউএস বাংলা অ্যাসেটস্, ইউএস বাংলা এয়ারলাইনস, ইউএস বাংলা মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল, গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, কুরিয়ার প্রতিষ্ঠান ইউএসবি এক্সপ্রেস, ইউএস বাংলা লেদার ইন্ডাস্ট্রিজ, ইউএস বাংলা ফুটওয়্যার, ইউএস বাংলা হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ, ইউএস বাংলা অটোমোবাইলস্, ইউএস বাংলা ফুডস্, ইউএস বাংলা ফ্যাশনসসহ আরো নানাবিধ প্রতিষ্ঠান। সময়ের হিসাবে ইউএস বাংলা গ্রুপের ব্যবসার পরিধি রহস্যজনকভাবে বেড়েছে, যা বাংলাদেশে অনেকটাই বিরল। 


ভ্যাট প্রশাসন সূত্র জানায়, ইউএস বাংলা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইউএস বাংলা অ্যাসেটস লিমিটেড ঢাকার অতি সন্নিকটে পূর্বাচলে যে পূর্বাচল আমেরিকান সিটি প্রকল্প রয়েছে, তাতে ভ্যাট ফাঁকি চলছে ফ্রিস্টাইলে। ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউএস বাংলা অ্যাসেটস লিমিটেডের অন্য দুই আবাসন প্রকল্প হলো- ইস্ট আমেরিকান সিটি ও হলিডে হোমস কুয়াকাটা। এ তিন আবাসন প্রকল্পের ভ্যাট ফাঁকি দীর্ঘদিন যাবৎ ধরা -ছোঁয়ার বাইরে। এ বিষয়ে ইউএস বাংলার মিডিয়া কর্মকর্তা কামরুল ইসলামকে কয়েকবার ফোন দিলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি তার।