বাউফলে পান চাষে ধস : কমছে বরজ, বাড়ছে চাষিদের দুঃশ্চিন্তা
মো. তরিকুল ইসলাম (মোস্তফা),বাউফল (পটুয়াখালী): উপকূলীয় পটুয়াখালীর বাউফল একসময় পরিচিত ছিল সবুজ পান–বরজের জনপদ হিসেবে। উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামজুড়ে ছয়–সাত দশক আগে শুরু হয়েছিল পান চাষের ব্যাপক বিস্তার। মদনপুরা, নাজিরপুর, কালাইয়া, চন্দ্রদ্বীপসহ বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে প্রতিদিন পান সরবরাহ হতো বরিশাল ও ঢাকার পাইকারি বাজারে। উর্বর মাটি, অনুকূল আবহাওয়া ও দীর্ঘ অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে বাউফলে পান ছিল সবচেয়ে লাভজনক ফসল। সংসার চালানো থেকে উচ্চশিক্ষার ব্যয়—সবই মিটত পান চাষের আয় থেকে।
কিন্তু সেই স্বর্ণযুগ এখন অতীত। রোগবালাই, অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার, বাজারদরের অনিশ্চয়তা ও শ্রমিক সংকট মিলিয়ে পান চাষ কমতে কমতে নেমে এসেছে মাত্র ২০–২৫ হেক্টর জমিতে।
চাষিদের নাভিশ্বাস
পান চাষি আলমগীর গাজী বলেন,
“১০০ শতাংশ জমিতেই পান চাষ করি। কিন্তু দুই বছর ধরে খরচই তুলতে পারছি না। পানে এখন নিয়মিতই রোগ দেখা দেয়। আগে দুই–এক ধরনের ওষুধে চলত, এখন কোম্পানির লোকেরা এসে সাত–আট ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করতে বলে। কৃষি অফিস থেকে কেউ আমাদের বরজে এসে কোনো পরামর্শ দেয়নি, অনুদানও পাইনি।”
বরজ তৈরি করতে কাঠ, বাঁশ, খুঁটি, শ্রমিকসহ খরচ পড়ছে ৫০–৬০ হাজার টাকা। সামান্য বৃষ্টি বা জলাবদ্ধতাতেই বরজে পচন ধরে যায়। ফলে অনেকে বরজ তুলে অন্য ফসলে ঝুঁকছেন।
বাজার ব্যবস্থায় চরম দুরবস্থা
বাউফলে নেই কোনো স্থায়ী পান সংগ্রহকেন্দ্র। স্থানীয় দালালদের নিয়ন্ত্রণে চাষিরা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন। ঢাকাসহ বড় বাজারে পাঠাতে হলেও পরিবহন ব্যয় কেটে লাভের বড় অংশ হারিয়ে যায়।
অতিরিক্ত কীটনাশকে নতুন ভয়
রোগবালাই দমনে চাষিরা এখন নানা কোম্পানির প্রচুর রাসায়নিক ব্যবহার করছেন। এতে উৎপাদন ব্যয় যেমন বাড়ছে, তেমনি মাটির গুণগত মান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগ–প্রতিরোধী জাত ও জৈব ব্যবস্থাপনা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকা সম্ভব নয়।
কৃষি বিভাগের বক্তব্য
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মিলন বলেন, বাউফলে আনুমানিক ৩১০ জন পান চাষ করেন। “পান চাষিদের জন্য আলাদা প্রণোদনা এখনো পাইনি। তবে আমাদের প্রশিক্ষণ ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে থাকেন।”
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আমিনুল ইসলাম বলেন,
“পান আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। কৃষকেরা চাইলে ইউনিয়নভিত্তিক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের থেকে সারের মাত্রা, কীটনাশকের ধরনসহ প্রয়োজনীয় সব নির্দেশনা পেতে পারেন। সরকার সবসময় কৃষকের পাশে আছে এবং মৌসুমভিত্তিক বীজ ও সার প্রণোদনা প্রদান করছে।”
ফিরে আসার সম্ভাবনা এখনো আছে
পান এখনো লাভজনক অর্থকরী ফসল। বিশেষ করে সাদা পাতার পানের বিদেশে উল্লেখযোগ্য চাহিদা রয়েছে। আধুনিক সেচ–ড্রেনেজ ব্যবস্থা, সমবায়ভিত্তিক বরজ, সংরক্ষণ ও বাজারব্যবস্থার উন্নয়ন করা গেলে বাউফলের পান চাষ আবারও ফিরে পেতে পারে তার পুরোনো গৌরব।
বিআলো/ইমরান



