বেকারত্বের হার বেড়ে ৪.৬৩ শতাংশে পৌঁছালো: রপ্তানি ও বিনিয়োগে মন্দা
দেশে বর্তমান সময়ে নতুন কোনো বিনিয়োগ হয়নি
বন্ধ চার শতাধিক শিল্প-কারখানা
দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ না নিলে বিপর্যয়
পোশাক খাতের সমস্যা করোনা সময়কাল থেকেই শুরু — মোহাম্মদ হাতেম. সভাপতি, বিকেএমইএ
উৎপাদন হ্রাসের ফলে বিদেশি ক্রেতাদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে–মোফাজ্জল হোসেন পাভেল, সভাপতি বিজিবিএ
দেশে বর্তমান সময়ে নতুন কোনো বিনিয়োগ হয়নি
বন্ধ চার শতাধিক শিল্প-কারখানা
দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ না নিলে বিপর্যয়
বিশেষ প্রতিনিধি: দেশে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর সর্বশেষ ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, আগের অর্থবছরের একই সময়ে বেকারত্বের হার ছিল ৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে (প্রথম প্রান্তিক) বেকারত্বের হার ছিল ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গণঅভ্যুত্থান এবং পরবর্তীতে ঢাকার প্রধান শিল্পাঞ্চলগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে ওই সময়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছিল। এদিকে গত এক বছর থেকে স্বাভাবিকভাবে চালাতে না পারায় মিল-কারখানা বন্ধ হয়ে প্রতি মাসে বেকার হচ্ছে প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার শ্রমিক। ওই হিসাবে প্রতিদিন ৪ হাজার একশ’রও বেশি কর্মজীবী শ্রমিক কাজ হারাচ্ছে। বর্তমানে অর্থনৈতিক মন্দা, গ্যাস ও জ্বালানি সংকট আর রাজনৈতিক অস্থিরতায় একেবারে মুমূর্ষু অবস্থায় চলে গেছে দেশের শিল্প-কলকারখানা।
বর্তমান সরকারের আমলে বিদেশিরা বিনিয়োগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আর অন্তর্বর্তী সরকারও দেশের অর্থনীতির গতি ফেরাতে এবং কল-কারখানায় উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ফলে বিভিন্ন এলাকায় বন্ধ হচ্ছে একের পর এক কলকারখানা। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তু‘তকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) তথ্যানুযায়ী গত এক বছরে দেশে বন্ধ হয়েছে ২৫৮টি রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা। তাছাড়া অন্যান্য শিল্প কারখানাসহ বন্ধ হয়েছে মোট চার শতাধিক শিল্প কল-কারখানা। তাতে বেকার হয়েছে কমপক্ষে ১৫ লাখ শ্রমিক। শিল্পখাত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে দেশে নতুন বিনিয়োগ না হওয়ায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে বেকারত্ব বেড়েই চলেছে। আর যেসব মিল-কারখানা সাময়িক বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে তার বেশির ভাগ কারখানাই আর চালু হচ্ছে না। কাজ না পেয়ে অনেক বেকার শ্রমিক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। তাতে সমাজে অস্থিরতা বাড়ছে। এমনিতেই বিগত সরকারের শাসনামলের দেশের অর্থনীতি চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। বর্তমানে পরিস্থিতি তার চেয়েও ভয়াবহ রকম খারাপ। যদিও দেশের মানুষ প্রত্যাশা ছিলো রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের অর্থনীতি দ্রুত চাঙ্গা হবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। কিন্তু ওই আশা এখন দুরাশায় পরিণত হয়েছে।
সূত্র জানায়, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে দেশে নতুন কোনো বিনিয়োগ হয়নি। বরং দেশে বিভিন্ন স্থানে বন্ধ হয়েছে গার্মেন্টস ও কল-কারখানা। ফলে বেকারত্ব বাড়ছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং জ্বালানি সংকটে বিগত এক বছরে দেশে ১৮৫টি তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। তাতে বেকার হয়েছে কয়েক লাখ শ্রমিক। গত দুই মাসে ৬ শতাংশ রফতানি আয় কমেছে। আর্থিক সংকট, ঋণের পরিমাণ বেশি থাকা, ব্যাংক থেকে নতুন ঋণ না পাওয়া, এলসি জটিলতা এবং কাজের অর্ডারের অভাবে কারখানাগুলো বন্ধ হয়েছে। রপ্তানি আদেশ না থাকায়ও অনেক তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ রয়েছে। আবার কিছু কারখানা অর্ডার পাওয়ার পর চালু হচ্ছে, আবার বন্ধ রাখা হচ্ছে। তাছাড়া গ্যাস সংকট ও নির্মাণ সামগ্রীর চাহিদা কমে যাওয়ায় ইস্পাত খাতের অনেক কারখানা বন্ধ। গত এক বছরে ১৩টি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড, স্টিলমিল এবং প্যাকেজিং কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে। শ্রমিক অসন্তোষের কারণেও অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। শিল্প পুলিশের হিসাবে গত এক বছরে চট্টগ্রাম ইপিজেডসহ নগরীতে ৭০টি কারখানায় ৩১৫ বার শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে।
সূত্র আরো জানায়, দেশে বন্ধ হয়ে যাওয়া জুটমিলগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আর হাজার হাজার শ্রমিক পরিবার চরম দারিদ্র্যের মুখোমুখি। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে দীর্ঘদিনের লোকসানের অজুহাতে খুলনা অঞ্চলের ৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করে দেয়া হয়। তাতে প্রায় ২৫ হাজার স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিক চাকরি হারায়। প্লাটিনাম, ক্রিসেন্ট, দৌলতপুর, ইস্টার্ন, আলিমসহ ৯টি পাটকলে গত ৫ বছরে একাধিকবার ইজারার জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হলেও কার্যকর ফল আসেনি। স্টার এবং ক্রিসেন্ট জুট মিলেও একই অবস্থা। একাধিকবার চুক্তি সম্পন্ন হলেও মিলগুলো চালু হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে বেকার হয়ে পড়া হাজার হাজার শ্রমিক বাধ্য হয়েছেন পেশা পরিবর্তন করছে। তাছাড়া গাজীপুর জেলার টঙ্গী, কোনাবাড়ী, কালিয়াকৈর, শ্রীপুর, গাজীপুর সদরসহ বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় প্রায় পাঁচ হাজার শিল্প কারখানা রয়েছে। গত এক বছরে বিভিন্ন সংকটের কারণে ওই জেলায় শতাধিক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার শ্রমিকরা পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। আবার বেকার হওয়া শ্রমিকদের একটি অংশ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। মূলত জ্বালানি সংকট, ব্যাংকিং খাতে অসহযোগিতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্ডার না থাকা, কার্যাদেশ বাতিল, শ্রমিক আন্দোলনসহ বৈশ্বিক নানা সংকটে কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।
এদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, অন্তর্বতী সরকার আসার কারণেই বিভিন্ন পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে তা ঠিক নয়। কয়েকটি কারখানা আগে থেকেই বন্ধ হওয়ার উপক্রম ছিল। পোশাক খাতের সমস্যা মহামারি করোনা সময়কাল থেকেই শুরু হয়েছে। আর ব্যাংকের সুদহার বেড়ে গেলে, অর্ডার কমতে থাকায় ও ব্যাংকঋণ বিতরণে বিমাতাসুলভ আচরণ এবং প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ করতে না পারায় কারখানাগুলো দুর্বল হতে থাকে। আর দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তিত পরিস্থিতির পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল না। সব মিলিয়ে কারখানাগুলোর আরো নাজুক অবস্থা সৃষ্টি হলে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বিজিবিএর সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন পাভেল জানান, ক্রমাগত কারখানা বন্ধ হওয়া এবং উৎপাদন হ্রাসের ফলে বিদেশি ক্রেতাদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। রপ্তানি আদেশও আগের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে। গত দুই মাসে তৈরি পোশাক রফতানি ৫ থেকে ৬ শতাংশ কমেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্ক, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, যা একত্রে শিল্প খাতের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান জানান, গত এক বছরে দেশে ২৫৮টি রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী শিল্পখাত নানা চ্যালেঞ্জের মুখে। সরকার যদি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তাহলে পোশাক খাত মুখ থুবড়ে পড়বে। বিশেষ করে নির্বাচিত সরকার দ্রুত না এলে দেশে শিল্প-কলকারখানার স্থবিরতা কাটবে না।
বিআলো/তুরাগ



