মানুষ ও বকের হৃদয়ছোঁয়া সম্পর্ক: বাউফলের ‘সাদা বক হেমায়েত ভাই
মো.তরিকুল ইসলাম (মোস্তফা),বাউফল:ভালোবাসা শুধু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; তা ছড়িয়ে আছে জীবজগতের প্রতিটি প্রাণে। এই সত্যের এক অনন্য উদাহরণ দেখা গেছে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার নুরাইনপুর বাজারে। স্থানীয় দোকানি হেমায়েত উদ্দিন ও এক সাদা বকের অদ্ভুত বন্ধুত্ব এখন সারা এলাকায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
প্রায় দুই মাস আগে স্থানীয় একটি গাছের নিচে আহত অবস্থায় পড়ে ছিল একটি বকের ছানা। মানবিক বিবেচনায় হেমায়েত উদ্দিন সেটিকে তুলে এনে নিজের যত্নে চিকিৎসা করেন। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে বকটি। তারপর থেকেই সে যেন হেমায়েত ভাইয়ের ছায়াসঙ্গী হয়ে ওঠে।
প্রতিদিন সকালে হেমায়েত ভাই দোকান খুলতে আসেন, সঙ্গে আসে তার প্রিয় বকটি। সন্ধ্যায় দোকান বন্ধ হলে বকটিকে নিয়েই বাড়ি ফেরেন তিনি। প্রতিদিন বকের জন্য তাজা মাছ কিনে আনেন। দোকানের এক কোণে রাখা পাত্রে মাছ রেখে দেন তিনি, আর সেখান থেকেই ধীরে ধীরে খায় বকটি। খাওয়ার পর হেমায়েত ভাই নিজ হাতে টিস্যু দিয়ে বকটির ঠোঁট মুছে দেন। এমন দৃশ্য দেখতে প্রতিদিনই ভিড় করেন আশপাশের মানুষ। কেউ ছবি তোলেন, কেউ আবার ফেসবুকে লাইভ দেন।
এভাবে অল্প সময়েই হেমায়েত উদ্দিন পরিচিত হয়েছেন “সাদা বক হেমায়েত ভাই” নামে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—তিনি বকটিকে খাঁচায় বন্দি করে নয়, উন্মুক্ত অবস্থায় লালন-পালন করছেন।
ঘটনাটি জানাজানি হলে বাউফল উপজেলা বন বিভাগ বকটিকে অবমুক্ত করার উদ্যোগ নেয়। গত ২৭ অক্টোবর (২০২৫ ইং) বকটিকে উপজেলা পরিষদের সামনে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মাত্র দুই দিন পরই—২৯ অক্টোবর সকালে বকটি আবার ফিরে আসে হেমায়েত ভাইয়ের দোকানে!
হেমায়েত ভাই বলেন: “ওকে ছেড়ে দিতে কষ্ট হয়েছিল, কিন্তু নিয়ম মানতেই হয়েছে। ও যখন ফিরে এল, মনে হলো ওর মনও আমার কাছেই পড়ে গেছে।” একজন নারী দর্শনার্থী বলেন:মানুষের মতো প্রাণীকেও ভালোবাসা দিয়ে লালন করছেন হেমায়েত ভাই—এটা সত্যিই বিরল।”
দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মরিয়ম বেগম বলেন: “বন বিভাগ বকটিকে ছেড়ে দিলেও সে আবার ফিরে এসেছে। এতে বোঝা যায়, মানুষের ভালোবাসা প্রাণীকেও টানে।”
নুরাইনপুর বাজারের ব্যবসায়ী ফিরোজ আলম জোমাদার বলেন:“হেমায়েত ভাই আমাদের নুরাইনপুরের গর্ব। তিনি মানুষ ও পাখির ভালোবাসার এক জীবন্ত উদাহরণ।” একই এলাকার বাসিন্দা নাজমুল হুদা বলেন, “বন বিভাগ বিষয়টি মানবিকভাবে বিবেচনা করবে বলে আমরা আশা করি। কারণ, হেমায়েত ভাই ও সাদা বকের সম্পর্ক এখন আমাদের সবার অনুভূতির অংশ।”
এই ঘটনাটি অনেককে মনে করিয়ে দেয় প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সেই হৃদয়স্পর্শী গল্পটি— হযরত আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন, “আমার একটি ছোট ভাই ছিল, তার নাম ছিল আবু উমায়ের। তার একটি ছোট পাখি ছিল, যার সঙ্গে সে খেলা করত। একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসে দেখলেন ছেলেটি মন খারাপ করে বসে আছে। তিনি বললেন, ‘হে আবু উমায়ের, তোমার নুঘায়র (ছোট পাখি) কী করলো?’” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং: ৬১২৯) একটি শিশু পাখির মৃত্যুতেও নবীজি শিশুটিকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। সেই শিক্ষা ছিল প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা, মমতা ও সহানুভূতির। আজ নুরাইনপুরের হেমায়েত ভাই যেন সেই নবীজির শিক্ষার এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি—মানুষ ও প্রাণীর নিখাদ বন্ধনের প্রতীক।
এই মায়াময় সম্পর্ক এখন শুধু নুরাইনপুর নয়, গোটা বাউফলের মানুষের মুখে মুখে। সবাই যেন একস্বরেই বলছে ভালোবাসা সত্যিই সীমানাহীন।



