শেখ হাসিনার রায়কে ন্যায়বিচারের সূচনা বলছে মাগুরার শহীদ পরিবারগুলো
এস এম শিমুল রানা, মাগুরা: মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর সারাদেশের মতো মাগুরা জেলাজুড়েও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের পরিবারগুলো রায়কে ঘিরে শোক, ক্ষোভ, স্বস্তি ও আক্ষেপের মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। রায় ঘোষণার পরদিন থেকেই মাগুরা সদর, শ্রীপুর, মহম্মদপুরসহ বিভিন্ন উপজেলার শহীদ পরিবারের বাড়িতে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। কেউ নীরবে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছেন, কেউ আবার আন্দোলনে হারানো সন্তানদের স্মৃতি মনে করে ভেঙে পড়ছেন। অনেকে বলছেন, “এ ন্যায়বিচারের পথের প্রথম ধাপ মাত্র।”
মাগুরা সদর উপজেলার জগদল ইউনিয়নের আজমপুর গ্রামের শহীদ রাজুর মা বলেন, “আল্লাহ বিচার করছেন। ছেলে মারা যাওয়ার দিনই বলেছিলাম—একদিন বিচার হবেই। আজ মনে হয় সেই কথাটা সত্য হলো। আমার ছেলে রাজনীতি করত না, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল বলেই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। রায় দেখে মনে হলো তার মৃত্যু বৃথা যায়নি।” তিনি আরও বলেন, “বছরের পর বছর বিচার চেয়েছি, কেঁদেছি। আজ মনে হচ্ছে আল্লাহ আমাদের আর্তনাদ শুনেছেন।”
শহীদ আহাদের মা বলেন, মা সন্তানকে ফিরে পায় না। তবে ন্যায়ের আলো দেখতে পেলে বুক কিছুটা হালকা লাগে। তার ছেলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তোলার দায়েই প্রাণ হারিয়েছে।
গত বছরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল কোটা সংস্কার, চাকরিতে সমান সুযোগ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জবাবদিহির দাবিকে সামনে রেখে। প্রথমে শান্তিপূর্ণ থাকলেও পরে দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। শহীদ পরিবারগুলোর দাবি অনুযায়ী নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে শতাধিক শিক্ষার্থী নিহত হন। অনেক তরুণ নিখোঁজ হন এবং শত শত মানুষ গুলিবিদ্ধ বা প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েন। নিহতদের অধিকাংশের বয়স ছিল ১৮ থেকে ২৬ বছর। এই প্রেক্ষাপটে শহীদ পরিবারগুলো রায়টিকে “আংশিক ন্যায়বিচারের সূচনা” হিসেবে দেখছেন।
রায় ঘোষণার পরদিন রাতেই ঢাকা থেকে মাগুরা পর্যন্ত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররা মিছিল, মোমবাতি প্রজ্জ্বলন ও নীরবতা পালন করেন। এক শিক্ষার্থী বলেন, “এই রায় দেখিয়ে দিল ক্ষমতা রক্তের দামে পুষে যেতে পারে না।” আরেক শিক্ষার্থীর ভাষায়, শহীদ ভাইদের ত্যাগের ওপর দাঁড়িয়েই আজকের এই ন্যায়ের বিজয়।
মাগুরা সদর উপজেলার বরুনাতৈল গ্রামের শহীদ মেহেদী হাসান রাব্বির স্ত্রী বলেন, “শেখ হাসিনাকে জনগণের সামনে এনে প্রকাশ্যে গুলি করে ফাঁসি দিলে যদি মনে শান্তি পেতাম। আল্লাহ উচিত বিচার করছেন। আল্লাহ ছাড় দেন, কিন্তু ছাড় দেন না।” শ্রীপুর উপজেলার নহাটা গ্রামের শহীদ আসিফ ইকবালের কাকা বলেন, “বিচার হয়েছে। কিন্তু পূর্ণতা তখনই আসবে যখন বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে।”
পরিবারগুলো বলছে, তারা রায়কে ন্যায়ের পথে একটি ধাপ হিসেবে দেখছেন। তবে ন্যায়ের পথে অপেক্ষা এখনও দীর্ঘ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই রায় রাষ্ট্রীয় জবাবদিহির নতুন ধাপ তৈরি করবে। ছাত্র আন্দোলনের নৈতিক অবস্থান আরও শক্তিশালী হলো। একই সঙ্গে ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সতর্কবার্তাও তৈরি হলো। তবে রায় কার্যকর হবে কি না—তা নির্ভর করবে আপিল প্রক্রিয়া, আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর।
রায়ের পরদিন মাগুরার গ্রামাঞ্চলেও শহীদ পরিবারের বাড়িতে মানুষের ভিড় লক্ষ করা গেছে। কেউ শহীদদের কবর জিয়ারত করেছেন, কেউ পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন, কেউ স্মৃতিচারণ করেছেন। এক প্রবীণ বলেন, শহীদ মেহেদী হাসান রাব্বি ছিল গ্রামের গর্ব। তার মৃত্যু শুধু গ্রামের নয়, দেশেরও বিবেককে নাড়া দিয়েছে।
মহম্মদপুর উপজেলার বালিদিয়া ইউনিয়নের শহীদ সুমনের মা বলেন, “আমার ছেলে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রাণ দিয়েছে। আজকের রায় তার আত্মত্যাগের স্বীকৃতি। এখন চাই একটি সমতাভিত্তিক, বৈষম্যহীন দেশ।”
মাগুরার শহীদ পরিবারগুলোর অভিমত—রায় ন্যায়বিচারের পথে একটি অগ্রগতি। তবে যাত্রা এখনো শেষ হয়নি। তাদের দাবি, ভবিষ্যতে যেন কোনো পরিবারকে সন্তানের মৃত্যু নিয়ে সারাজীবন হাহাকার করতে না হয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন, এই রায় সেই আত্মত্যাগের স্বীকৃতি। তারা বলছেন—এখন প্রয়োজন বৈষম্যহীন, সবার জন্য সমান অধিকারের দেশ।
বিআলো/ইমরান



