সব অর্জনের বাতিঘর শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

সব অর্জনের বাতিঘর শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

এম. এ. বাসার: প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস যেন বাংলাদেশেরেই ইতিহাস। বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ের সঙ্গে এই বিশ্ববিদ্যালয় জড়িত। ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামসহ বাঙালির প্রতিটি গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই দেশের যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে এই বিশ্ববিদ্যালয়ই সবার আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।

দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, সমাজব্যবস্থা, রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনস্বীকার্য অবদান রেখেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধি চর্চা এবং নতুন জ্ঞানের অনুসন্ধান ও আবিষ্কার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কর্তব্য। পৃথিবীর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো গত ১০০ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ কাজটি করে যাচ্ছে নিরলসভাবে। প্রতিবছর দেশের সর্বাধিক গ্র্যাজুয়েট এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তৈরি হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিশেষত্ব হলো বাংলাদেশ স্বাধীন করতে এর বিশেষ অবদান ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি বিশ্লেষণ করে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে বলা হয়ে থাকে, সাধারণত দেশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে। শিক্ষা ও গবেষণার পাশাপাশি এ বিশ্ববিদ্যালয় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী।  মুক্তিযুদ্ধকালে পাক-সরকারের বুদ্ধিজীবী নিধন পরিকল্পনার শিকার হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯ জন শিক্ষক। ২৫ মার্চ রাতে আরো শহিদ হন ১০৪ জন ছাত্র, ১ জন কর্মকর্তা ও ২৮ জন কর্মচারী। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রাচীনতম, সর্ববৃহৎ এবং উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান। ১৯২০ সালে ভারতীয় বিধানসভায় গৃহীত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইনবলে ১৯২১ সালের ১ জুলাই আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। সেই হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০২১ সালের আজকের (১ জুলাই) দিনে তার পথচলার সেঞ্চুরি (শতবর্ষ) পূর্ণ করবে। ৩টি অনুষদ (কলা, বিজ্ঞান ও আইন), ১২টি বিভাগ, ৬০ জন শিক্ষক, ৮৪৭ জন ছাত্র-ছাত্রী এবং ৩টি আবাসিক হল নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ১৩টি অনুষদ, ৮৩টি বিভাগ, ১২টি ইনস্টিটিউট, ৫৬টি গবেষণা ব্যুরো ও কেন্দ্র, ২০টি আবাসিক হল ও ৩টি ছাত্রাবাস এবং ৭টি স্নাতক পর্যায়ের অধিভুক্ত সরকারি কলেজসহ মোট ১০৫টি অধিভুক্ত কলেজ রয়েছে। বর্তমান মোট ৩৭০১৮ জন শিক্ষার্থী এবং ১৯৯২ জন শিক্ষক রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো- ‘হল’; প্রতিটি শিক্ষার্থীকে কোনো না কোনো হলের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হয়। হলের গেস্টরুম কালচার নিয়ে সমালোচনা থাকলেও এটা যেন ম্যানার-এটিকেট শেখার আতুরঘর। সাংস্কৃতিক মিথষ্কিয়ার কেন্দ্রস্থল হলের গণরুম; স্বল্পমূল্যে হল ক্যান্টিনের খাবার, সেলুন, লন্ড্রি শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ডিমবন, বাটারবন, মিক্সডসবজি/চায়নিজ সবজি, ব্রাঞ্চ (ব্রেকফাস্ট+লাঞ্চ) শব্দগুলো অনেকের কাছেই নতুন হতে পারে, হলের পাতলা ডালের কথা মনে থাকবে আজীবন। হলের পত্রিকা রুম, রিডিং রুম, গেমস রুমের স্মৃতি মনের কোণে থাকবে আজীবন। অনুরোধ না করা সত্ত্বেও মশার গান শোনেনি বা মি. ছারপোকার সঙ্গে বেড শেয়ার করেননি, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না!  বাংলাদেশের খেলা শুরুর পূর্বে জাতীয় সংগীত গাওয়ার সঙ্গে  সঙ্গে টিভি রুমের দর্শকদের দাঁড়িয়ে সম্মান জানানো, করতালির মাধ্যমে প্রতিটি মুহূর্তে উৎসাহ-উদ্দীপনা প্রদান করা, জিতে গেলে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আনন্দ মিছিল করা বা হেরে গেলে নীরবে চোখের জল ফেলার স্মৃতিগুলো আজীবন লালন করার মতো।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়! নামটি শুনলেই যেন কল্পনায় ভেসে ওঠে এক রঙিন জীবনের হাতছানি। লালচে আভার কার্জন হল, ঐতিহাসিক অপরাজেয় বাংলা বা রাজু ভাস্কর্য, মল চত্বর ,  ভিসি চত্বর বা হাকিম চত্বরের আড্ডার স্মৃতিগুলো আবেগতাড়িত করতে বাধ্য। প্রাণোচ্ছল আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু টিএসসি, রাজনীতির সূতিকাগার মধুর ক্যান্টিন ও ডাকসু, স্বাধীনতা সংগ্রামের বহু উত্থান-পতনের সাক্ষী বটতলাসহ আরো কত শত স্বপ্নিল স্থানের খণ্ডচিত্র এসে জমা হয় মানসপটে! হাসি-আড্ডা-গানে মুখরিত এই প্রাণের ক্যাম্পাসে পদচারণার স্মৃতি জাগরূক থাকে সারাটি জীবন।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাবেক হলে আবেগ যেন আরো বেড়ে যায়। ক্যাম্পাসের রঙিন আঙিনা প্রতিনিয়ত হাতছানি দিয়ে ডাকে। কর্মস্থলে প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউকে পেলেই মনটা চঞ্চল হয়ে ওঠে, পঠিত বিষয় বা হল মিলে গেলে তো কথাই নেই, মনে হয় কতনা আপন! সাবেকি মন আনমনেই বলে ওঠে ইশ! আবার যদি ক্যাম্পাস লাইফে ফিরে যেতে পারেতাম; যদি যোগ দিতে পারতাম রাতের গান-আড্ডায়, যদি ফিরে পেতাম ক্লাসের ব্যাকবেঞ্চার সময়গুলো। সুযোগ পেলে একটিবার ছুয়ে দেখতাম প্রিয় ক্যাম্পাসের প্রতিটি ঘাস, লতা-পাতা। একান্ত বাধ্যগত ছাত্র হয়ে যেতাম, বোরিং মনে হওয়া সকাল ৮টার ক্লাস বা দুপুরের ক্লাসগুলো মিস করতাম না কখোনোই। অপূর্ণতাগুলো পূর্ণ করতাম, সত্যিকারের মানুষ হতাম। 

মেধা-মননে, নেতৃত্বে দেশবরেণ্য বহু পুরোধা ব্যক্তিত্বের জন্ম দিয়েছে প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৪৯ সালে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব হারিয়েছিলেন। ১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ সাময়িক বহিষ্কার করা হয় এবং মুচলেকা দিতে রাজি না হওয়ায় ১৮ এপ্রিল তাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২০১০ সালের ১৪ আগস্ট এক সিন্ডিকেট সভায় বঙ্গবন্ধুর ছাত্রত্ব কেড়ে নেওয়ার তৎকালীন সিদ্ধান্তটি বাতিল করেছে।

বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। ‘সেলিব্রেটিং দ্য হান্ড্রেড ইয়ার্স অব দি ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা : রিফ্লেকশন ফ্রম দি অ্যালামনাই-ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড ন্যাশনাল’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের দেশের সর্বোচ্চ সম্মানজনক একটি বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাঙালি জাতির সব অর্জনের বাতিঘর। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য যে মানবসম্পদ গড়ে তোলা দরকার, সেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে পড়বে তাতে দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আলোকিত হয়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলায় ব্রতী হবে।’

হেনরি কিসিঞ্জারের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নামক দেশটির ঝুড়ি এখন সাফল্যে পরিপূর্ণ। রিজার্ভ, রেমিট্যান্স, প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়ে বাংলাদেশ নিত্য-নতুন রেকর্ড করছে। বাংলাদেশে অনেক মেগা উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে, বড় বড় ফ্লাইওভার করা হয়েছে, মেট্রোরেল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে,  মহাকাশে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়েছে, দেশজুড়ে রাস্তাঘাট কালভার্ট নির্মাণ করা হচ্ছে,  দেশের সর্ববৃহৎ পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ নিজস্ব অর্থায়নে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। কৃষি, খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ, নারীর ক্ষমতায়ন, আর্থ-সামাজিক প্রতিটি সূচক ও জরিপে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ভিশন -২০২১ এর মাধ্যমে আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি এবং ভিশন -২০৪১ এর মাধ্যমে আমরা আধুনিক এবং উন্নত দেশে পরিণত হব। বাংলাদেশের এই অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় অনস্বীকার্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার মেধাবী সন্তানদের। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পেশার রাজনৈতিকায়ন, ছাত্ররাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব অবশ্য ইতিবাচক প্রভাবও কম নয়, আবাসিক হলের সিট সংকট, বাজেট বরাদ্দের বিশেষ করে গবেষণায় অপ্রতুলতা, ভৌত অবকাঠামোর দুর্বলতা, এসব কারণে হয়তো বিশ্বসূচকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছে। তবুও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সবার অনুভূতি গর্বের।

জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এদেশের সব আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘জাতীয় ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, মহান স্বাধীনতা আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 
প্রাণের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিগত ১০০ বছরে জাতিকে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড উপহার দিয়েছে, সফলতার সঙ্গে বসবাস করার সুযোগ দিয়েছে প্রতিনিয়ত, অসংখ্য আলোকিত মানুষ উপহার দিয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্তানগুলো সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশের সেবায় কাজ করে চলেছে প্রতিনিয়ত।  শত-সহস্র প্রতিকূলতা পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাঙালির নিযুত প্রেরণা, লাখ-কোটি সফলতা আর অর্জনের বাতিঘর। শুভ জন্মদিন বাংলাদেশের সব অর্জনের বাতিঘর শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শতবর্ষ পেরিয়ে ছুঁয়ে যাও সহস্রবর্ষ, এগিয়ে যাও অসীমের পানে।

এম. এ. বাসার
লেখক ও গবেষক
ই-মেইল: bashar.nctb@gmail.com

বিআলো/ইলিয়াস