স্ক্রিনে বন্দী সমাজ: স্মার্টফোন আসক্তিতে ভাঙছে সম্পর্ক, বাড়ছে আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতি
মো.তরিকুল ইসলাম (মোস্তফা),বাউফল (পটুয়াখালী): স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট আধুনিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যোগাযোগ, শিক্ষা, চিকিৎসা ও ব্যবসাসহ নানামুখী ক্ষেত্রে প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে করেছে সহজ ও গতিশীল। তবে নিয়ন্ত্রণহীন ও অতিরিক্ত ব্যবহারে এই প্রযুক্তিই ধীরে ধীরে সমাজে সৃষ্টি করছে এক নীরব সংকট। স্মার্টফোন আসক্তির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পারিবারিক সম্পর্ক, বাড়ছে আর্থিক অপচয় এবং দেখা দিচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়।
দুই হাতে দুই মোবাইল, সম্পর্ক হয়ে উঠছে ফাঁপা
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সূত্রে জানা যায়, ২০২৫ সালের শুরুতে দেশে মোবাইল সিম সংযোগের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮ কোটি ৮০ লাখে। অর্থাৎ একজন মানুষের বিপরীতে একাধিক সিম ব্যবহার এখন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
প্রতিদিন কলরেট ও ইন্টারনেট প্যাকেজে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে। অথচ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যবহার না হওয়া মিনিট ও ডাটা দিনশেষে অপারেটরদের কাছেই থেকে যাচ্ছে। এতে গ্রাহকের সরাসরি আর্থিক ক্ষতি হলেও এ বিষয়ে কার্যকর কোনো নীতিগত উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান নয়।
একাধিক সিম ব্যবহারে শিক্ষার্থীসহ অনেকের জীবনে বিপর্যয়
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘন ঘন সিম পরিবর্তন ও একাধিক সিম ব্যবহারের প্রবণতা অনেকের জীবনে বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করছে। সময়মতো যোগাযোগ না হওয়ায় চাকরি, ভর্তি, পরীক্ষা কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত সুযোগ হারাচ্ছেন অনেকে।
বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই সমস্যা তুলনামূলক বেশি, যা তাদের পড়াশোনা, মানসিক স্থিতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
দাম্পত্য সম্পর্কে বাড়ছে দূরত্ব
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, স্মার্টফোন আসক্তির সবচেয়ে গভীর প্রভাব পড়ছে দাম্পত্য জীবনে। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক কথোপকথন ও আবেগ বিনিময়ের সময়টুকু এখন কেটে যাচ্ছে আলাদা আলাদা স্ক্রিনে চোখ রেখে।
এর ফলে কমছে পারস্পরিক বোঝাপড়া, বাড়ছে মানসিক দূরত্ব। অনেক ক্ষেত্রে এই আসক্তি দাম্পত্য কলহ, বিচ্ছেদ এমনকি সন্তানদের ভবিষ্যৎকে ঘিরে পারিবারিক ভাঙনের কারণ হয়ে উঠছে।
সামাজিক বন্ধনে ফাটল
একসময় সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে সশরীরে উপস্থিত হয়ে কুশল বিনিময় ছিল আমাদের সংস্কৃতির অংশ। বর্তমানে সেই জায়গা দখল করেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মেসেজ, রিলস ও পোস্ট।
ফলে কমছে সামাজিক আন্তরিকতা, শিথিল হয়ে পড়ছে মানবিক সম্পর্ক এবং দুর্বল হচ্ছে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা।
স্বাস্থ্যের ওপর নীরব আঘাত
চিকিৎসকদের মতে, দীর্ঘ সময় স্মার্টফোন ব্যবহারে চোখে জ্বালা, ঝাপসা দেখা, মাথাব্যথা ও ঘুমের সমস্যার হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। মোবাইল ফোনের ব্লু লাইট ঘুমের জন্য প্রয়োজনীয় ‘মেলাটোনিন’ হরমোনের নিঃসরণ ব্যাহত করে।
পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে বাড়ছে মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও একাকিত্ব। পাশাপাশি ‘ফাবিং’—প্রিয়জনকে উপেক্ষা করে ফোনে মগ্ন থাকার প্রবণতা—পারিবারিক সম্পর্কের ভিতকে আরও দুর্বল করে তুলছে।
ধর্মীয় দৃষ্টিতেও ভারসাম্যের গুরুত্ব
ইসলাম ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপনের নির্দেশ দেয়। পবিত্র কোরআনে ঘুমকে আল্লাহর নিয়ামত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে (সূরা আর-রূম: ২৩)। একই সঙ্গে দাম্পত্য জীবনে ভালোবাসা ও প্রশান্তির কথা বলা হয়েছে (সূরা আর-রূম: ২১)।
হাদিসে রাসুলুল্লাহ হযরত মুহাম্মদ (সা.) পরিবারকে যথাযথ সময় ও গুরুত্ব দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ স্মার্টফোন আসক্তি সেই অধিকার ও জীবনের ভারসাম্যকে ব্যাহত করছে।
উপসংহার
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রযুক্তি নিজে কোনো সমস্যা নয়; সমস্যা হলো এর লাগামহীন ও অসচেতন ব্যবহার। স্মার্টফোন ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধি, পারিবারিক ও সামাজিক সময়ের গুরুত্ব অনুধাবন এবং ভোক্তা অধিকার সুরক্ষায় কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি।
নচেৎ ‘স্ক্রিনে বন্দী’ এই সমাজ ভবিষ্যতে আরও গভীর মানবিক ও সামাজিক সংকটের মুখোমুখি হতে পারে।
বিআলো/ইমরান



