স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাজেট ভাবনা
ড. মো. নাছিম আখতার: ২০৪১ সালের রূপকল্প স্মার্ট বাংলাদেশ, যার স্তম্ভগুলো হলো- স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সমাজ, স্মার্ট অর্থনীতি ও স্মার্ট গভর্নমেন্ট। পৃথিবীতে সব কিছুর উন্নয়ন ও মূল্য নির্ধারিত হয় মানুষকে কেন্দ্র করে। সুতরাং মানুষ যদি স্মার্ট অর্থাৎ পরিচ্ছন্ন ও ধীশক্তিসম্পন্ন দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত হয়, তবেই স্মার্ট বাংলাদেশ গঠিত হবে। দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে একটি দেশের সঠিক ক্ষেত্রে বরাদ্দকৃত বাজেট বিশেষ ভূমিকা রাখে। দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের পর্যায়গুলোর মধ্যে রয়েছে দুর্নীতিমুক্ত পরিচ্ছন্ন শিক্ষা, প্রশিক্ষণের সুবিধা ও স্বচ্ছতা, স্কুল-কলেজ ও উচ্চশিক্ষায় ব্যাবহারিক জ্ঞান আহরণের সুব্যবস্থা করা। শুধু সুব্যবস্থা করলেই হবে না, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ এগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন করছেন কি না, তা স্মার্ট পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তদারকি করতে হবে।
বর্তমান বিশ্বে স্মার্ট পর্যবেক্ষণ কেমন হবে, তা একটি উদাহরণের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। চীনে চিকিৎসা বিষয়ে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি একজন শিক্ষার্থী, ছদ্মনাম রিফাত। পরীক্ষার হলে প্রবেশের আগে মোবাইল ফোন হোস্টেলে রেখে যেতে ভুলে যায়। সেটি তার প্যান্টের পকেটেই ছিল। সেখানকার নিয়মানুযায়ী মোবাইল ফোন পকেটে রাখা যাবে, কিন্তু বের করা যাবে না। ফোনটি মিউট করা ছিল না। পরীক্ষা চলাকালে একটি নোটিফিকেশন আসে ও সামান্য শব্দ হয়। রিফাত ফোনটি পকেট থেকে বের করে তা মিউট করে আবার পকেটে রেখে দেয়। সর্বোচ্চ পাঁচ সেকেন্ডের এই কার্যকলাপ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ক্যামেরায় ধরা পড়ে। সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্টের সময় রিফাত জানতে পারে পরীক্ষায় মোবাইল ফোনের অনৈতিক ব্যবহারের কারণে তাকে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আমাদের দেশেও পরীক্ষার মতো স্পর্শকাতর বিষয়টিকে পরিচ্ছন্ন রাখতে এআই মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে।
এবারের বাজেটে এআই মনিটরিং বাস্তবায়নের জন্য ধাপভিত্তিক অর্থ বরাদ্দ রাখা যেতে পারে। আমাদের স্কুল ও কলেজে ব্যাবহারিক ক্লাসের বিষয়গুলো থাকলেও খুব কম স্কুল-কলেজেই ব্যাবহারিক ক্লাসগুলো করানো হয়। ব্যাবহারিক ক্লাস না করিয়ে পরীক্ষায় ব্যাবহারিকের জন্য স্কুল পর্যায়ে মোট ১০০ নম্বর এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে মোট ২০০ নম্বর দেওয়া হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে ব্যাবহারিক ক্লাসের এই দুর্বলতা বিজ্ঞান শিক্ষায় দুর্বল শিক্ষার্থী তৈরি করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা ব্যবহার করে ব্যাবহারিক ক্লাস উপযোগী ডিজিটাল মডিউল তৈরি করা সময়ের দাবি। এভাবেই প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য নিয়মিত ব্যাবহারিক ক্লাস পরিচালনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রেও বাজেট বরাদ্দের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।স্মার্ট বাংলাদেশ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বিকাশের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠবে। তাই প্রযুক্তিনির্ভর মানবসম্পদ উন্নয়নে থাকতে হবে সরকারের নিবিড় পর্যবেক্ষণ।
সাম্প্রতিককালের একটি জরিপ বলছে, প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার কম্পিউটার সায়েন্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েট তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশে। কিন্তু বাংলাদেশের চাকরির বাজারে সাড়ে সাত থেকে আট হাজার দক্ষ মানবসম্পদ সরবরাহ করতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যানুযায়ী শতকরা ৮০ ভাগ চাকরিপ্রার্থী কম্পিউটার প্রগ্রামিং এবং গণিত বিষয়ে খুবই দুর্বল। এই দুর্বলতা লাঘবে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও দেশে গণিত শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়নে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখা দরকার।
প্রযুক্তিনির্ভর কাজগুলোর বেশির ভাগই বসে থেকে মাথা খাটানোর কাজ। ফলে এই খাতের দক্ষ জনবল যাতে অসুস্থ না হয় এ জন্য নিবিড় পর্যবেক্ষণ জরুরি। পৃথিবীর জায়ান্ট আইটি কম্পানিগুলোতে শরীরচর্চা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়া হয়। আমাদের দেশেও এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করার বিষয়ে ভাবতে হবে।
এগুলো ছাড়াও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়ানো, রেমিট্যান্স বাড়ানোর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উন্নয়ন, ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ- এসবই এবারের বাজেট থেকে প্রত্যাশা। সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ। তাই দেশের সামগ্রিক অগ্রগতিতে তথ্য-প্রযুক্তির সুবিধা অব্যাহত রাখতেই হবে। পাঁচ বিলিয়ন ডলার আইটি এক্সপোর্টের লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট সময়ে অর্জিত হয়নি। আবারও আমরা নতুন সময় নির্ধারণ করেছি। তাই সময় এসেছে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দেশের আইটি খাতের সহায়ক পরিবেশ আরো সুদৃঢ় ও জোরদার করার, যাতে আমাদের আইটি খাত একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারে। নির্মিত হতে পারে আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ।
লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
বিআলো/শিলি